মায়ান সভ্যতা

মায়ান সভ্যতা প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম নিদর্শন।
ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত, সেই খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে মায়ান সভ্যতা বিকাশ লাভ করে মধ্য আমেরিকায়। মেক্সিকো এবং গুয়েতেমালার গহিন জঙ্গলে বিস্তৃত চুনাপাথরের পাহাড়ে ইউকাতান পেনিনসুলায় রয়েছে অসংখ্য রহস্যময় মন্দির, পাথরের দেয়াল, পিরামিড এবং বিশাল বিশাল পিলারের সারি। ইউকাতানের চিচেন ইতসাই ছিল মায়া সভ্যতার রাজধানী।

মায়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত হচ্ছেন সেইসব মানুষ যারা প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির এবং আধুনিক জনগণ, যারা মেক্সিকোর দক্ষিণে এবং উত্তর-মধ্য আমেরিকাতে বসবাস করতো এবং তারা মায়াভাষী় পরিবারের মানুষ। প্রথমদিকে এর সময় কাল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-২৫০ অব্দ পর্যন্ত। এর মধ্যে প্রাচীন কালে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেক মায়া নগরীগুলোতে তাঁরা উন্নতির উচ্চশিখরে পৌঁছেছিল এবং স্প্যানিশদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পুরো পোস্টক্লাসিক জুড়ে চালিয়ে গিয়েছিল। এটি ছিলো বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ঘন জনবসতি এবং সংস্কৃতিভাবে গতিশীল একটি সমাজ।

মেসো শব্দটা গ্রিক। যার মানে মধ্য। যেমন মেসোপটেমিয়া। এর মানে: দুই নদীর মধ্যেখানের অঞ্চল। তেমনি, মেসোআমিরিকায় বলতে বোঝায় মধ্যআমেরিকাকে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে (প্রধানত মেক্সিকো) । মেসোপটেমিয়া কতগুলি সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল। যেমন, ওলমেক, অ্যাজটেক, মায়া। এর মধ্যে মায়া সভ্যতার উদ্ভ ও বিকাশ ছিল অভূতপূর্ব। বর্তমান মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ ও হন্ডুরাসজুড়ে ছড়িয়ে ছিল মায়া সভ্যতা। লিখিত ভাষাসহ মেসোআমিরিকার সবচে উন্নত সভ্যতা ছিল মায়া সভ্যতা।

আজকের মেস্কিকানরা মায়ানদের উত্তরপুরুষ। আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেক্সিকো বা এই পুরো ক্যারিবিয়ান বেল্টে মায়ান সভ্যতার শুরু। বর্তমানে মায়ান স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের সবটাই পোস্ট ক্লাসিক্যাল মায়া সভ্যতার। আনুমানিক ৭০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ এই স্থাপত্যগুলোর ইতিহাসকাল । মায়ানরা লিখতে জানত তাদের অক্ষরের সংখ্যা ১০,০০০। প্রাকটেলিস্কোপহীন জ্যোর্তিবিদ্যার নানান নমুনার স্বাক্ষর তাদের স্থাপত্যে। রাজনৈতিক নিয়ম ছিল রেনেসাঁস সাময়িক ইউরোপের মতো নগর রাষ্ট্র। আনুমানিক শতাধিক নগর রাজ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল মায়ান সাম্রাজ্য, যা স্প্যানিশ আক্রমণে ১৬৮০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। যদিও মায়ানরা ১৭০ বছর ধরে ইউরোপিয়ান হার্মাদ দস্যুদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই করে গেছে। কিন্তু ক্রমাগত বিদ্রোহ এবং গেরিলা যুদ্ধ করেও হার মেনেছে বন্দুক এবং কামানের কাছে। স্প্যানিশরা এদের দাশ হিসেবে ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপে চালান করত।

ক্যাঙ্কুন এলাকায় মায়ান সভ্যতার দুটি বিখ্যাত ধ্বংসাবশেষ আছে। টুলুম আর চিচেনিটজা। টুলুমে আছে সূর্য মন্দির। অনেকটা কোনার্কের মতো। আর চিচেনিটজাতে আছে পিরামিড। টুলুমের সূর্য মন্দির অবশ্য কোনার্কের মন্দিরটির চেয়ে অনেক ছোট। স্থাপত্য এবং কারুকার্যও তেমন কিছু নয়। যদিও কোনার্ক এবং টুলুমের সূর্যমন্দিরের বয়স প্রায় সমসাময়িক। তবে কোরাল রিফের ওপর তৈরি এই মন্দিরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়।ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের কোরাল রিফের ধারে গড়ে উঠেছিল মায়ানদের বিখ্যাত সূর্যমন্দির।

মায়ানদের সব রাজ্যই ছিল নগর-রাজ্য। তবে নগরে থাকত শ’দুয়েক বণিক এবং রাজা। শ্রেণী বিভক্ত মায়ান সমাজে, নিচু শ্রেণীর মায়ানদের বাস ছিল দেয়ালের বাইরের গ্রামে। সূর্য মন্দিরে বছরে চারবার নরবলি হওয়ার হিসাব পাওয়া যায়। মূলত অপরাধীদের দেবতার কাছে বলি দিত মায়ানরা। তাদের নরখুলি মন্দিরগাত্রে শোভা বর্ধনের কাজে লাগানো হতো বলে জানা যায়। আহ্নিকগতি পর্যবেক্ষণের জন্য পিনহোল তৈরি করে দরজার ওপর ফেলাটা গ্রিক, মিসর এবং ভারতের মতো এখানেও চালু ছিল। তবে মায়ানদের সমস্যা হচ্ছে এরা ঘোড়া বা পুলির ব্যবহার জানত না। ফলে ভারী পাথর বেশি ওপরে তুলতে পারেনি কেননা সব কিছুই মানুষদের গায়ের জোরে করা। মূলত এরা মিসরের মতো বড় পিরামিড বা কোনার্কের মতো বড় সূর্যমন্দির বানাতে পারেনি। মায়ানদের মধ্যে কিছু স্প্যানিশ প্রথম আসে ১৫১৪ সালে।

উন্নতির শীর্ষে মায়া সভ্যতার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লক্ষ । বেশির ভাগই বাস করত এখনকার গুয়েতেমালায়। নগরগুলি আসলে ছিল ধর্মীয় কেন্দ্র। বেশির ভাগ মায়া বাস করত নগরের বাইরে –গ্রামে, কৃষিজীবনে।৯০০ শতকের পর গুয়েতেমালার মায়া নগরগুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণের নগরগুলি জনশূন্য হয়ে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে যুদ্ধের কারণে বানিজ্যপথের পরিবর্তনই নাকি এর অন্যতম কারণ। তবে মেক্সিকোর ইউকাটন উপদ্বীপের চিচেন ইটজা, উক্সমাল এবং মায়াপান সংস্কৃতির বিকাশ অব্যাহত থাকে ১৫১৯ অবধি। ষোড়শ শতকে যখন মেসোআমেরিকায় স্পেনিশ লুটেরারা এল তখন বেশির ভাগ মায়াই গ্রামীণ কৃষিজীবনে সম্পৃক্ত।মায়ারা চাষ করত ভূট্টা, বীন ও লাউ। মাংসের মধ্যে খেত টার্কি, তাপির, খরগোশ, বানর ও ম্যাকাও পাখি।

মায়ারা আজ রোমান ক্যাথলিজমে বিশ্বাসী হলেও পূর্বেকার মায়া বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, দেবদেবী ও গৃহস্থালী পরব পালন করে আজও। মায়ারা অনেক দেবতায় বিশ্বাসী ছিল। সে দেবতা ভালো কি মন্দ হতেন। ইটজামনা ছিলেন প্রধান দেবতা। তিনি সৃষ্টিকর্তা, আগুন ও উনুনের দেবতা। অন্যএকজন হলেন পালকযুক্ত সরীসৃপ;কুকুলকান। ইনি বৃষ্টি ও বজ্রপাতের দেবতা। মায়াদের উপসনালয়ে এর মূর্তি পাওয়া গেছে। মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাসী ছিল মায়ারা। মৃত্যুর পর আত্মার বিপদজনক ভ্রমন শুরু হত পাতালদেশে। পাতালের অধিকর্তা দেবতা অমঙ্গলকর। সে দেবতার প্রতীক জাগুয়ার। জাগুয়ার রাত্রিরও প্রতীক।

গণিত ও জ্যোর্তিশাস্ত্র অভূতপূর্ব উন্নতি করেছিল। অবশ্য সে জ্ঞান অর্জন ছিল ধর্মীয় কৃত্যের সঙ্গে জড়িত । গণিতে শূন্যের ব্যবহার, পজিশনাল নোটেশন নির্ধারণ করেছিল মায়ারা; জ্যোর্তিশাস্ত্রে সৌর বৎসরের গননা, চন্দ্র ও শুক্র গ্রহের অবস্থান এমনকী সূর্যগ্রহনও আগেভাবে বলে দিতে পারত তারা!মায়ারা প্রকৃতির আবর্তন লক্ষ করেছিল। সময় নিয়ে অবসেসড ছিল। তারা মনে করত বিশ্বজগৎ ৫ বার সৃষ্টি হয়েছে আর ৪ বার ধ্বংস হয়েছে। বছরের কোনও কোনও দিন শুভ কোনও কোনও দিন অশুভ। একসময় ঐতিহাসিকদের ধারনা ছিল মায়ারা শান্তিপ্রিয় । ধর্মনিয়ে মগ্ন থাকে। মায়া হাইয়ারোগ্লাফিক লেখনি পড়তে পারার পর জানা গেল তারা প্রতিদ্বন্দি নগর আক্রমন করত। শাসককে বন্দি করত, টর্চার করত, তারপর তাকে দেবতার কাছে বলি দিত!নরবলি বা হিউম্যান স্যাক্রিফাইস ছিল মায়াদের ধর্মবিশ্বাসের মূলে।মায়ারা নরবলি দিত উর্বরতা, ধর্মনিষ্টা দেবতার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে । মায়া পুরোহিত বিশ্বাস করত দেবতা মানুষের রক্তে পুষ্ট হন! রক্তই দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়।
সময় এর সাথে হারিয়ে গেছে এই জনপথ। কাল এর অন্তরায় এ আমরা ও হারিয়ে যাব একদিন।

বি:দ্র: প্রতিটি লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুকপেজ-এ লাইক দিন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। যেকোন বিষয়ে জানতে চাইলে এবং আপনার কোন লেখা প্রকাশ করতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ বিডি লাইফ এ যেয়ে ম্যাসেজ করতে পারেন।

খবরগুলো আপনার ফেসবুক হোমপেজে নিয়মিত আপডেট পেতে লাইক করুন