চুল পড়ার প্রকৃত কারন

আমরা যে চুল সাধারণত মানুষের মাথায় দেখতে পাই তা হল কেরাটিনের মৃত কোষ। একজন মানুষের মাথায় গড়ে এক থেকে দেড় লক্ষ চুল থাকে। এর মধ্যে প্রায় প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ টি চুল ঝরে যায়। অর্থাৎ ১০০ টি চুল পড়া স্বাভাবিক। কিন্তু যখন ১০০ টির বেশি চুল পড়ে যায় তখনই মাথার তালু খালি হয়ে যেতে থাকে। তাই চুলের যত্নে চুল পড়ার প্রকৃত কারন ও তার প্রতিকার জানা খুবই জরুরী
চুল বৃদ্ধি বা গজানোর জন্য চুলের একটি জীবনচক্র আছে। এই চক্রের তিনটি পর্যায় হলোঃ
এনাজেন (Anagen)- চুলের বৃদ্ধির সময়কে বলে এনাজেন। এনাজেন ২ থেকে ৬ বছর স্থায়ী হয়। মাথায় অবস্থিত চুলের প্রায় ৯০ শতাংশ চুল সব সময় এনাজেন বা বৃদ্ধি হতে থাকে।
ক্যাটাজেন (Catagen)-  এটি একটি অস্থায়ী প্রর্যায়। এটি কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
টেলোজেন (Telogen)- চুলের জীবনচক্রের সর্বশেষ পর্যায় টেলোজেন। এটি ২ থেকে ৪ মাস স্থায়ী হয়। একে রেস্টিং ফেজও বলে। এসময় কিছু চুল পড়ে যায় এবং এসব ফলিকল থেকে নতুন চুল গজায়। টেলোজেন পর্যায় দীর্ঘতর হলে চুল বেশি পড়ে যায়। এছাড়া চুলের ফলিকল শুকিয়ে গেলে চুল নাও গজাতে পারে।
চুল পড়ার কারণ:-  চুল পড়া একটি স্পর্শকাতর সমস্যা। চুল পড়ার কারন নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। চিকিৎসা শাস্রে বলা হয়, চুলপড়ার কারণ ডাইহাইড্রক্সি টেস্টোস্টেরন বা ডিএইটি (DHT), ডিএইচটি (DHT) একটি পুরুষ হরমোন। পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন থেকে আলফারিডাকটেজ এনজাইমের সাহায্যে তৈরি হয় ডিএইচটি (DHT)।ডিএইচটি (DHT) চুলের ফলিকলের গোড়ায় গিয়ে তাদের বৃদ্ধি রোধ করে এবং রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। এভাবেই চুল পড়তে শুরু করে। সুতরাং DHT বেড়ে গেলে চুল পড়তে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে টাকের সৃষ্টি হয়।

চুল পড়ে যাওয়াকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
অ্যানাজেন ইফ্লুভিয়ামঃ নানারকম ওষুধ ও কেমোথেরাপির জন্য যখন চুল পড়ে যায় তখন তাকে বলে অ্যানাজেন ইফফ্লুভিয়াম।

টেলোজেন ইফ্লুভিয়ামঃ চুলের ফলিকল যখন রেস্টিং স্টেজে যায় তখন তাকে টেলোজেন ইফ্লুভিয়াম বলে। চুলের ফলিকল রেস্টিং স্টেজ যাওয়া মানে চুল আর বড় না হওয়া এবং এক সময় চুল ঝরে যাওয়া।

যে সব কারনে চুল ঝরে যায়ঃ-

  • শারীরিক অসুস্থতা– যেকোন অপারেশনের পর, রক্ত স্বল্পতা, ওজন কমে যাওয়া, হজমে সমস্যা, পুষ্টিহিনতা, দেরিতে ধুমাতে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে না ঘুমনো, সঠিক খাদ্যাভ্যাস না থাকা ও ধূমপানের কারনেও চুল পড়ে যায়।
  • মানসিক চাপ– অতি কর্মব্যস্ততা, পরিবারের কারো মৃত্যু, সম্পর্কের টানাপোড়ন, পারিবারিক অশান্তি।
  • থাইরয়েড হরমোনজনিত সমস্যা,
  • ডায়াবেটিস পলিসিসটিক ওভারি ,
  • মূত্রনালীর প্রদাহ,
  • গর্ভাবস্থা, পরিবার পরিকল্পনার জন্য পিল খাওয়া,
  • মেয়েদের মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া,
  • অতি মাত্রায় ভিটামিন এ গ্রহণ, উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ গ্রহণ,
  • ওজন কমোনোর জন্য অতিরিক্ত ডায়েটিং,
  • ওষুধ–কিছু কিছু ওষুধ যেমন ক্যান্সারের ঔষধ, যে চুলগুলো মাত্র গজাচ্ছে সেগুলোও ঝরিয়ে দেয়। এছাড়া অর্থ্রাইটিস, গাউট, এন্টিবায়োটিক, মানসিক অবসাদের ওষুধ দীর্ধদিন ধ্রে সেবন করলে চুল পড়ে যায়।
  • জ্বরের পর– কঠিন কোন জ্বর, যেমন টাইফয়েড, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও নিউমোনিয়া হলে চুল ঝরে যায়।
  • প্রসব পরবর্তী– সন্তান প্রসবের ২ থেকে ৫ মাস পর হঠাৎ চুল পড়ে যেতে থাকে।
  • নবজাত অবস্থায়– নবজাতকের মাথার চুল জন্মের পর থেকে চার মাসের ভিতরে অনেকটা ঝরে যায়।তবে পরে ঠিক হয়ে যায়।
  • ছত্রাক– ছত্রাকরে সংক্রমণ বড় ছোট সবারই হতে পারে। এর জন্য মাথার চুল পড়ে যেতে পারে। একে টিনিয়া ক্যালিটিস বলে।
  • কেরিয়াল– মাথার ত্বক ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়। এতে ত্বকের উপরের অংশ মোটা হয়ে যায় এবং আক্রান্ত অংশের চুল ঝরে যায়।
  • ফেবাস– এতেও ত্বকের উপরিভাগ পুরু হয়ে যায়। ত্বকের রং হলুদ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত অংশের চুল পড়ে যায়। এক্ষেত্রে সময়মত চিকিৎসা না করালে আর চুল গজায় না।
  • গ্রে প্যাচ– মাথার পিছনের অংশের চুল পড়ে যায়। একটি জায়গায় গোল হয়ে ভাঙ্গুর চুলে জায়গাটি ছেয়ে থেকে।
  • ব্ল্যাকডট টিনিয়া– এ ধরনের সংক্রমণেও চুল পড়ে যায়। ভঙ্গু্র চুলের গোড়া কালো রং ধারন করে বলে একে ব্ল্যাকডট টিনিয়া বলে। মাথার বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে সংক্রমণ হতে পারে। ব্ল্যাকডট টিনিয়া হলে সংক্রমিত অংশ খুব চুলকায়।
  • অ্যামিনেট ফলিকুলাইটিস– একে সাধারণ ভাষায় গোটা বলা হয়। বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অংশ দানার আকারে লাল হয়ে অল্প ফুলে উঠে। ফলিকুলের গোড়া ফুলে উঠে বা সংক্রমিত হয়ে এমনটা হয়। চুলের গোড়ায় ছোট পুঁজ ভর্তি ফোসকা থাকে। এতেও মাথা চুলকাতে পারে।
  • পায়োডার্মা– শিশুদের মাথার ত্বকে এমনটি হয়ে থাকে। আক্রান্ত অংশ লাল হয়ে ফুলে যায় ও ব্যথা হয়। এছাড়া মাথা বা গলার পেছনের গ্ল্যান্ডও সংক্রমিত হয়ে ফুলতে পারে।
  • সিফিলিস– সিফিলিসের দ্বিতীয় পর্যায়ে চুলের সংক্রামণ হতে পারে। মাথায় নানা জায়গায় চুল পরে যেতে পারে। তবে পিছনের দিকে বেশি দেখা যায়।
  • উকুন– উকুন বা পেডিকুলোসিস ক্যাপিটিস হলে মাথার ত্বক খুব চুলকায় এবং চুল পড়ে যায়।
  • খুশকি– মাথার ত্বকে মরা কোষ জমে অনেক সময় খুশকি হয়ে থাকে। খুশকির কারনে মাথা খুব চুলকায় এবং চুল ঝরে যায়। অপরিষ্কার থাকলে অর্থাৎ ঠিকমত মাথা পরিষ্কার না করলেও চুল পড়ে যায়।

এছাড়া আরো কিছু কারণ আছে, যেগুলো চুল পড়ে যাওয়ার জন্য দায়ীঃ-
>>আজকাল অনেকেই চুলের বিভিন্ন স্টাইল করতে যেয়ে চুলের সে স্থায়ী ক্ষতি করে ফেলেছেন সে বিষয়ে কোন খেয়ালেই রাখেন না। হেয়ার ড্রায়ার, হিট, কেমিক্যাল, হেয়ার কালার, জেল ইত্যাদি ব্যবহার চুলের জন্য ক্ষতিকর।
>>স্ট্রেইনিং, রিবন্ডিং, আয়রণ, কালার এরকম নানা পদ্ধতিতে এখন চুল সুন্দর ও পছন্দসই করা যায়। কিন্তু তার কিছু পরেই শুরে হয় সমস্যা। চুলের কিউটিকল বা বাইরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হলে চুল ভঙ্গু্ল হয়ে যায়। অতিরিক্ত তাপের কারণে চুল পড়তে শুরু করে। এছাড়া কেমিক্যালের কারনে চুল রুক্ষ হয়ে ওঠে, আগা দ্বিখন্ডিত হয় এবং চুল ঝরে পড়ে।
>>দূষনের কারনেও চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত ধুলা-ময়লার কারনে চুলের গোড়ায় ময়লা জমতে পারে। এ কারনেও চুল ঝরে পড়ে।
>>অল্প বয়সীদের অনেকেরই চুলের গোড়া তেলতেলে হয়ে যায়। এটি অতিরিক্ত সিবাম নিঃসরনের কারনে হয়। অতিরিক্ত রোদে বের হওয়া এবং চুল ভেজা থাকা, দীর্ঘ সময়  ধরে হেলমেট, টুপি ইত্যাদি পরে থাকার ফলে মাথা ঘেমে চুলের গোড়া নরম হয়ে যায় এবং চুল পড়ে যায়।

চুল পড়া নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণাঃ-

  • বেশি শ্যাম্পু করলে চুল পড়ে।
  • টুপি পরলে বা মাথায় কাপর দিলে চুল পড়ে।
  • প্রতিদিন ১০০ বার চুলে চিরুনি চালানো প্রয়োজন।
  • মাথা ন্যাড়া বারবার করলে ঘন চুল ওঠে।
  • খুশকি চুলের স্থায়ী ক্ষতি করে।
  • তেল না ব্যবহার করলে চুল পড়ে।
  • মানসিক চাপ চুলের স্থায়ী ক্ষতি করে।
  • অল্প বয়সে চুল পড়ে না।
  • জ্ঞানীদের চুল পড়ে যায়।

কৃতজ্ঞতাঃ ডা. আলমগীর মতি

বি:দ্র: প্রতিটি লেখার নিয়মিত আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুকপেজ-এ লাইক দিন এবং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। যেকোন বিষয়ে জানতে চাইলে এবং আপনার কোন লেখা প্রকাশ করতে চাইলে আমাদের ফেসবুক পেজ বিডি লাইফ এ যেয়ে ম্যাসেজ করতে পারেন।

খবরগুলো আপনার ফেসবুক হোমপেজে নিয়মিত আপডেট পেতে লাইক করুন